দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।
কবিগুরু যথার্থ লিখেছিলেন আমরা এখনো চোখ মেলে নিজের প্রকৃতি কে দেখিনি। আমাদের তো মন চায় প্রজাপতি হয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেরাতে, কিংবা পাখির মত ডানা ঝাপটিয়ে ইচ্ছেমত সবদিকে উড়ে বেড়াতে, কিন্তু আমাদের দ্বারা তো তা আর সম্ভব না । আবার চাইলে ও সব জায়গায় মন চাইলেই ছুটে যাওয়া সম্ভব না। এজন্য দরকার সময়, আর কিছু পূর্ব প্রস্তুতি।
কিন্তু আপনি চাইলেই বাংলার দার্জিলিং খ্যাত বান্দরবানে যে কোন সময় ছুটে যেতে পারেন। বান্দরবানের পাগল করা সৌন্দর্যের টানে সেখানে পর্যটকরা বারবার ছুটে জায়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে, ৪৪৭৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বান্দরবানের অবস্থান। এটি মূলত চিটাগং হিল ট্র্যাক এর একটি ছোট্ট অংশ। এখানে রয়েছে অসংখ্য নদী, পাহাড়, লেক আর আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তার দুপাশে সবুজের সমারোহ, স্নিগ্ধ বাতাস, মেঘের লুকোচুরি আর মেঘ ছোঁয়ার অনুভূতি পাওয়ার জন্য হলেও আপনাকে জীবনে একবার হলেও বান্দরবান আসতেই হবে। তবে তার আগে আপনাকে জেনে নিতে হবে, কিভাবে যাবেন বান্দরবান। কোথায় থাকবেন, খরচ কত হবে আর ঘুরবেনই বা কোন কোন জায়গায়? তাই চলুন এক পলকে দেখে নিই বান্দরবানের দর্শনীয় স্থান সমূহের মধ্যে কোন কোন জায়গায় না গেলেই নয়।
বান্দরবানের দর্শনীয় স্থান সমূহের তালিকা – Bandarban Tourist Spot
শৈলপ্রপাত ঝর্ণা ভ্রমণ
বান্দরবান গেলে শুরুতেই দেখে নিতে পারেন হীম শীতল পানির ধারা শৈলপ্রপাত ঝর্ণা। এটি বান্দরবান জেলা শহর থেকে খুবই কাছে। শৈলপ্রপাত ঝর্ণা বান্দরবান জেলা শহর থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-থানচি রোডের পাশেই অবস্থিত। এই ঝর্ণার আলাদা বৈশিষ্ট হচ্ছে এই ঝর্ণার বহমান হীম শীতল পানির ধারা। এই ঝর্ণার পাশেই পিকনিক করার জন্য রয়েছে অসাধারণ পরিবেশ।
এই ঝর্ণাটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি। এই ঝর্ণার হীম শীতল পানির প্রবাহ ঢালু পাথরের প্লেট দিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে। যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ এক সৃষ্টি। ঝর্ণার হিমশীতল পানি এই ঝর্ণায় সবসময় বহমান থাকে। এই ঝর্ণার পানিগুলো খুবই স্বচ্ছ । বর্ষাকালে শৈল প্রপাতে পানির প্রবাহ বাড়ার সাথে সাথে এখানে বাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের সংখ্যাও। তবে বর্ষাকালে এই ঝর্ণায় গেলে সাবধান থাকবেন। কারণ এসময় ঝর্ণাতে নামা দুস্কর। এই জল প্রপাতের আশপাশের পাহাড়েই বম সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। শৈল প্রপাতকে কেন্দ্র করে রাস্তার ধারে গড়ে উঠেছে অসাধারণ একটি হস্তশিল্প ও কাপড়ের মার্কেট। বমদের হাতে বোনা শাড়ি, বেডশিট, চাদর, মাফলার এবং বেত ও বাঁশের তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র স্মারক হিসাবে কিনে নিতে পারেন সাশ্রয়ী দামে।
দেবতাখুম ভ্রমণ
বান্দরবানের দেবতাখুম নামটডা আমাদের সবারই জানা। মূলত খুম মানে হলো জলাধার। বান্দরবানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দেবতাখুম এর মত ছোট-বড় অনেক গুলো খুম। এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং বড় খুম হলো দেবতাখুম। বান্দরবান জেলা শহর ২০ কিলোমিটার দূরের রোয়াংছড়ি উপজেলার শীলবাঁধা পাড়ায় এই খুমের অবস্থান। এই খুম বান্দরবানের দর্শনীয় স্থান সমূহের মধ্যে অন্যতম। এই খুমের গভীরতা ৫০ থেকে ৭০ ফিট। বিশালাকার পাথরের ঢালের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝরনা নদীর দৃশ্য যখন দেখবেন মনে হবে এক কল্পনার রাজ্যে আছেন। দেবতাখুমে যাওয়ার আগেই পড়বে ‘পং সু আং খুম নামে ছোট্ট এক খুম। এই খুম দিয়ে সাতার কেটে অথবা এর সঙ্গে সংযুক্ত গাছের শিকড় ধরে ঝুলে যেতে হবে দেবতাখুমে। এই খুমের পথ যতটা সুন্দর ততটাই ভয়ংকর।
ভেলা ছাড়া দেবতাখুমে যাওয়ার কোন উপায় নেই। ভেলা নিয়ে যতোই এগিয়ে যাবেন; ততোই জায়গাটা একদম সরু হয়ে আসবে! এমনো অনেক জায়গা ভেলা দিয়ে পাড় হতে হবে যেখানে সূর্যের আলো একদম কমই। দেবতাখুমে যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হচ্ছে জুন থেকে জানুয়ারি মাস। বৃষ্টির সময় এই খুম পানি দিয়ে ভরা থাকে। তাই আপনি চাইলে অনেকদূর পর্যন্ত ভেলা নিয়ে যেতে পারবেন। বর্ষায় দেবতা খুমের পানি অনেক বেড়ে যায়। তখন অবশ্য সেখানে যাওয়া কষ্টকর। এসময় পিচ্ছিল পাথুরে পথে পা ফসকে বড় ধরনের বিপদের সম্ভাবনা থাকে।
নীলগিরি ভ্রমণ
আপনি যদি কখনো আকাশের মেঘ ছুয়ে দেখার ইচ্ছে করে তাহলে আপনার সেই ইচ্ছে পূরণ হবে নীলগিরি তে এসে। সমুদ্র পৃষ্ট থেকে প্রায় ২২০০ ফুট উচ্চতায় নীলগিরির অবস্থান! এখানে দেখতে পাবেন আকাশ জুড়ে শুধু সবুজ পাহাড় আর তার সাথে সারাদিন মেঘের লুকোচুরি খেলা। বাংলাদেশের এই অপরুপ সুন্দর জায়গাটি সবাই দার্জিলিং এর সাথেও তুলনা করেন।
নীলগিরি তে আসলে আপনি সরাটাদিন শুধুই বিমোহিত হতে থাকবেন। আকাশ পরিস্কার থাকলে পাহাড়ের সারির পাশাপাশি নীলগিরির চূড়া থেকে চোখে পড়বে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত, বগালেক, কেওক্রাডং, চট্টগ্রাম বন্দর আর সাঙ্গু নদী। সময় থাকলে চাইলে মিশে যেতে পারেন এখানকার আদিবাসী সংস্কৃতির সাথে।
বগালেক ভ্রমণ
বগা লেক তৈরি হয়েছিল একটি মৃত আগ্নেয়গিরি পানি চুয়ে চুয়ে। তাই এই লেককে ড্রাগন লেকও বলে। বিশাল আকৃতির এই লেক দেখে আপনার এই বিশাল ভ্রমণ স্বার্থক মনে হবে। বগালেক দেখার পাশাপাশি আপনি চাইলে কেওক্রাডং চূড়াও জয় করে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আসতে পারেন। বগালেক থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টা হাঁটলেই আপনি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকতে পারেন। বর্ষা এবং শীতে খরচ কম করতে চাইলে শীতে যেতে পারেন বগালেকে। তবে সেরা ভিউ পেতে চাইলে যেতে হবে বর্ষাতে।
ডিম পাহাড় ভ্রমণ
মূলত ডিম পাহাড়টি বান্দরবানের থানচি এবং আলীকদম উপজেলার ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। এই পাহাড়ের আড়াই হাজার ফুট উঁচুতে নির্মাণ করা হয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু সড়কপথ। এই সড়কটি দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সড়কপথ। এ পাহাড়ের চূড়া দেখতে ডিমের মতো বলে স্থানীয়রা একে ডিম পাহাড় নামেই চিনে। শ্রাবণের সময় এই পাহাড়টি সাদা মেঘে আচ্ছন্ন থাকে। এই পাহাড়ে গেলে মনে হবে যেন মেঘের ওপরে সড়ক!
ডিম পাহাড় এলাকাটি সত্যিই সবুজের চেয়েও সবুজ। পাহাড়ি রাস্তার ধারে দেখবেন নানা রঙের পাহাড়ি ফুল। মেঘের ফাঁকে রোদের ঝিলিক বৃষ্টিস্নাত ফুলগুলোকে দেখতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো মনে হয়! উপর থেকে নিচের ঘরবাডি দেখলে মনে হবে যেন ছোট ছোট খেলনার ঘরবাড়ি। উপর থেকে শংখ নদীকে ও দেখতে মনে হবে সাপের মত। সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থান (Sylhet Tourist Spot) সমূহের তালিকা সহ বিস্তারিত তথ্য জানুন!
আলীর গুহা ভ্রমণ
বান্দরবান জেলার আলিকদম উপজেলায় অবস্থিত প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এক রহস্যময় গুহা হল আলীর গুহা। এই গুহাটি আলীর সুরঙ্গ নামেও পড়িচিত। আলীর পাহাড়ের নামে এই গুহার নামকরণ করা হয়েছে। এই গুহাটি আলীকদম থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মাতামুহুরি-টোয়াইন খাল ঘেঁষে থাকা এই গুহাটি নিয়ে রহস্যর কোনো শেষ নেই। এখানে মোট ৩টি গুহা রয়েছে। আপনি প্রত্যেকটি গুহা ঘুরে দেখতে সময় লাগবে প্রায় ২ ঘণ্টার মতো। এই গুহা গুলোতে আপনাকে যেতে হবে ঝিরি পথ ধরে। আর ঝিরি থেকে এই গুহার মুখ কিছুটা উপরে।
প্রথম গুহাটিতে সিঁড়ি করা আছে,তবে বাকি দু’টিতে পাহাড় বেয়ে আপনাকে উঠতে হবে। এই গুহার ভেতরে কিছু কিছু জায়গা একদম সরু। এসব জায়গায় আপনাকে হামাগুরি দিয়ে যেতে হবে। যেহেতুে এই গুহার ভেতরে পুরোটাই অন্ধকার সেহেতু এখানে যাওয়ার আগে সাথে টর্চ লাইট অবশ্যই নিয়ে যাবেন। গুহার ভেতরে ঢুকলেই কেমন জানি গাঁ ছমছম করে। আর এর পরিবেশটা খুবই স্যাঁতসেঁতে। এই গুহার এখানে আসলে আপনার এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা তৈরী হবে। এই গুহার ভেতর অনেক গুলো বাদুর দেখতে পাবেন, এই বাদুর গুলোকে মানুষ দেখলেই এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করে।
জেনে তো নিলেন বান্দরবানের দর্শনীয় স্থান সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান সমূহ এখন ব্যাগ গুছিয়ে বাংলার দার্জিলিং খ্যাত বান্দরবান দেখার পালা !