সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থান (Sylhet Tourist Spot) সমূহের তালিকা সহ বিস্তারিত তথ্য জানুন!
দুটিপাতা এবং একটি কুঁড়ির দেশ হিসেবে পরিচিত সিলেট। তাছাড়া ও সিলেট কে সারা দেশব্যাপী ৩৬০ আউলিয়ার দেশ হিসেবে সবাই চিনে। এছাড়া ও সিলেটের রয়েছে প্রসিদ্ধ একটি ইতিহাস। চা বাগানের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত সিলেটের দর্শনীয় স্থান এর যেন শেষ নেই। চা বাগানের পাশাপাশি সিলেটে রয়েছে রাতারগুল জলাবন, বিছানাকান্দি, হাকালুকি হাওর, জাফলং, মায়াবী ঝর্ণা, মনিপুরী রাজবাড়ী, হযরত শাহজালাল ও শাহ পরান (রাঃ) এর মাজার শরীফ সহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান।। চলুন এক পলকে দেখে নিই সিলেটের দর্শনীয় স্থান সমূহের মধ্যে কোন কোন জায়গায় না গেলেই নয়।
সিলেটের দর্শনীয় স্থান – Sylhet Tourist Spot
রাতারগুল জলাবন
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট বাংলাদেশের একমাত্র জলাবন বা সোয়াম্প ফরেস্ট। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এই বনের আয়তন প্রায় ৩,৩২৫.৬১ একর। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে ৫০৪ একর বনকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি সিলেটের দর্শনীয় স্থান এর মধ্যে অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য স্থান। এই জলাবনটিতে উদ্ভিদের দু’টো স্তর দেখা যায়। মূলত উপরের স্তরটি বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে গঠিত যেখানে নিচের স্তরটিতে ঘন পাটিপাতার আধিক্য চোখে পড়ে। এই অরণ্যের ৮০ শতাংশ এলাকাই উদ্ভিদে আচ্ছাদিত। এই বনে এখন পর্যন্ত সর্বমোট ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এই বন প্রাকৃতিক বন হলেও পরবর্তিতে বাংলাদেশ বন বিভাগ, বেত, কদম, হিজল, সহ নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে। এছাড়া জলমগ্ন এই বনে রয়েছে হিজল, করচ আর বরুণ গাছ; আরো আছে পিঠালি, অর্জুন ইত্যাদি গাছ। এই বনে বট গাছও দেখতে পাবেন। পর্যটকগণ জলে নিম্নাংঙ্গ ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বনের গাছগুলো দেখতে বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এখানে ভিড় করেন। বনের ভিতর ভ্রমণ করতে দরকার হয় ডিঙি নৌকা নৌকার। ডিঙি নৌকায় চড়ে বনের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে দেখা যায় প্রকৃতির অপরুপ রূপসুধা।
বিছানাকান্দি
‘বিছনাকান্দি’ সিলেট জেলার নবীনতম একটি ভ্রমণ গন্তব্য । বিছানাকান্দি সিলেট হতে ৬০ কিলোমিটার দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নের একটি সুন্দর গ্রাম। সিলেট বিমানবন্দর রোড ধরে বিছানাকান্দির পথ। দু’পাশের সবুজ চা বাগান পেছনে ফেলে আপনাকে যেতে হবে বিছনাকান্দি। বিছনাকান্দির মূল আকর্ষণ হল পাথর বিছানো বিস্তীর্ণ প্রান্তরের উপরে বয়ে চলা মেঘালয়ের পাহাড়ি ঝরনাধারা । বিছনাকান্দি গ্রামটি মুলত একটি কোয়েরি যেখানে নদী থেকে পাথর সংগ্রহ করা হয়। বিছনাকান্দিতে মূলত খাসিয়া পাহাড় থেকে নেমে এসেছে এক অপরুপ ঝর্ণা, যার পানিই সুন্দর এক হ্রদে রূপ নিয়েছে। আর এই হ্রদটি মিলিত হয়েছে পিয়াইন নামক নদীর সাথে।
যাওয়ার সময় হাদারপাড় বাজারের পাশের খেয়াঘাট থেকে নৌকা রিজার্ভ করে যাওয়া যায় বিছানাকান্দি। দর কষাকষি করে ৫০০ টাকার মধ্যে একটি নৌকা রিজার্ভ করবেন। যদিও এখানকার মাঝিরা পর্যটকদের কাছে অতিরিক্ত ভাড়া হাঁকায় । তাই আগে ভাগে ভাড়া ঠিক করে নেয়া ভলো।
নৌকা ভ্রমনের সময় দেখবেন দু’পাশের অপরুপ সবুজ গ্রামের প্রতিচ্ছবি। সেই সাথে দেখা মিলবে সুদূরে স্থির মেঘালয়ের পাহাড় গুলোর। নৌকা যতই সামনে আগাবে আপনি ততই অবাক হতে বাধ্য হবেন। মনে হবে সবুজ পাহাড়ের কোলে আরেক সাদা পাহাড় দেখতে পাচ্ছেন। নৌকায় পনের মিনিট মত ভ্রমণের পরই দেখা মিলবে বিছানাকান্দির। সীমান্তের ওপার থেকে বয়ে আসা স্বচ্ছ জলধারা বড় বড় পাথরের ফাঁকে যখন দেখবেন তখন আপনি চলে যাবেন এক মায়ার স্রোতে। স্রোতের মধ্যে ডুবন্ত পাথরের উপর যখন দাঁড়িয়ে থাকবেন মনে হবে এক অন্য রাজ্য আছেন। বিছনাকান্দি তে আকাশে ভাসমান মেঘের কোন শেষ নেই । বিছনাকান্দির হিম শীতল পানিতে নিজের শরীর ভিজানোর কথা ভুলবেন না।
কয়েক বছর আগে ও বিছানাকান্দি লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও এখন এটি বেশ পরিচিত দর্শনীয় স্থান। বর্ষার সময় বিছানাকান্দির পানির প্রবাহ বেড়ে যায় কয়েকগুন। এই সময় মূল ধারায় স্রোত অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সাঁতার জানা না থাকলে এ ভ্রমণে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট নেওয়া উচিৎ। বিছনাকান্দির বিছিয়ে আছে বাংলাদেশ আর ভারত মিলিয়ে। স্বাভাবিক ভাবে এখানে সীমানা চিহ্ণিত করা নেই । তাই এই জায়গাটিতে তাই সাবধানে বেড়ানো উচিৎ। বাংলাদেশের সীমানা ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়।
সিলেটের দর্শনীয় স্থান জাফলং
জাফলং সারাদেশে প্রকৃতি কন্যা হিসাবে পরিচিত। জাফলং খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। সিলেট নগরী থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলং এর অবস্থান। সিলেটের দর্শনীয় স্থান হিসেবে জাফলং অনেক আগে থেকে পরিচিত। পিয়াইন নামক নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে অপরুপ করেছে। সীমান্তের ওপারে ভারতের পাহাড় টিলা। তাছাড়া ও আছে ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরামধারায় নেমে আসা জলপ্রপাত।
গহিন অরণ্য, পাথরের স্তূপ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি, উঁচু উঁচু পাহাড় এবং শুনশান নিরবতার কারণে এলাকাটি পর্যটকদের দারুণভাবে মোহাবিষ্ট করে। দেশী-বিদেশী পর্যটকরা এসব দৃশ্যপট দেখতে প্রতিদিনই এখানে ছুটে আসেন। শীত এবং বর্ষা মওসুমে জাফলংয়ের সৌন্দর্যের রুপ ভিন্ন। বর্ষার সময় জাফলংএর রুপ লাবণ্য যেন ভিন্ন মাত্রায় ফুটে উঠে। হাজারফুট উপর থেকে নেমে আসা অপরুপ ঝর্ণাধারার দৃশ্য যে কারোরই নয়ন জুড়ায়।
মায়াবী ঝর্ণা
সংগ্রামপুঞ্জি বা ‘মায়াবী ঝর্ণা’ জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ১৫-২০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে অবস্থিত। এই ঝর্ণাটি ভারতের সীমান্তে পড়েছে। তবে আপনি চাইলে বিএসএফের প্রহরায় এ ঝর্নার চূড়ায় উঠতে পারেন। বেশ কয়েক ধাপবিশিষ্ট এরকম ঝর্না খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। ঝর্ণার সামান্য দূরে মেঘালয়ের পাহাড়ের বয়ে যাওয়ার গর্জন কানে আসে। পাথর আর পানির অপূর্ব মেলবন্ধন দেখবেন সেখানে। ঝর্ণার হাড় কাপানো পানি এই ঝর্ণায় সবসময় বহমান থাকে।
এই ঝর্ণার পানিগুলো খুবই স্বচ্ছ । বর্ষাকালে এই ঝর্ণার পানির প্রবাহ বাড়ার সাথে সাথে এখানে বাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের সংখ্যাও। তবে বর্ষাকালে এই ঝর্ণায় গেলে অবশ্যই সাবধান থাকবেন। কেননা এসময় এই ঝর্ণাতে নামা অনেক দুস্কর।
মালনীছড়া চা বাগান
মালনীছড়া চা বাগান উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন এবং বৃহত্তম চা বাগান। ১৮৪৯ সালে লর্ড হার্ডসন এক হাজার ৫০০ একর জায়গার ওপর এই চা বাগান টি প্রতিষ্ঠা করেন। সিলেট শহর থেকে রিকশাযোগে অথবা অটোরিকশা করে এই চা বাগানটি দেখতে পাওয়া যায়। মালনীছড়া গাড়িতে যেতে আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে মাত্র ১০ মিনিট এর পথ। তবে রিকশাযোগে গেলে প্রায় আধঘন্টা লাগবে। মালনীছড়ার প্রবেশপথ বেশ কয়েকটি রয়েছে। বান্দরবান জেলার দর্শনীয় স্থান (Bandarban Tourist Spot) সমূহের তালিকা সহ বিস্তারিত তথ্য জানুন!
আপনি চাইলে যেকোন প্রবেশ পথ দিয়েই এই চা বাগানে প্রবেশ করতে পারেন। তবে কোন প্রকার সমস্যা না হওয়ার জন্য আগে থেকে কতৃপক্ষের অনুমতি নেয়া ভাল। এই চা বাগান এলাকার বিখ্যাত খাদ্য আথনী পোলাও ও সাতকরার স্বাদ নিতে ভুলবেন না। তাছাড়া ও সেখান থেকে কিনতে পারবেন স্থানীয় আনারস, কমলা, পান, লেবু, কাঠাল, চা-পাতা ইত্যাদি।
হযরত শাহজালাল(রাঃ) মাজার শরীফ
ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন হযরত শাহজালাল (রাঃ)। সিলেটে তাঁর মাধ্যমেই ইসলামের প্রচার প্রসার ঘটেছে। সিলেট বিজয়ের পরে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর সঙ্গী অনুসারীদের মধ্য হতে অনেক পীর দরবেশ সিলেট সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আগমন করেন। শাহজালাল (রাঃ) ও তাঁর সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মাজার শরীফ জিয়ারত করে এখানকার জালালী কবুতর, গজার মাছ, চিলস্নাখানা এবং শাহজালাল (রাঃ) এর ব্যবহৃত দ্রব্যাদি দেখে নিতে পারেন।
হযরত শাহজালাল (র.) এর আধ্যাত্নিক শক্তির পরিচয় পেয়ে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রাঃ) তাঁকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। সিলেট এবং এর আশপাশের অঞ্চলে বর্তমানে যে জালালী কবুতর গুলো দেখা যায় তা ওই কবুতরের বংশধর । সিলেটে জাতিধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কেউই এ কবুতর খায় না এবং বধ করে না। জালালী কবুতর দেখার পর দেখে নিতে পারেন মাজার চত্বরের উত্তর দিকের পুকুরের গজার মাছ। এসব মাছকে পবিত্র মনে করে দর্শনার্থীরা বিভিন্ন কিছু খেতে দেয়। এ
রপর দেখে নিতে পারেন হযরত শাহজালালের (র.) চিলস্নাখানা। স্কথিত আছে যে, এই চিলস্নাখানায় হযরত শাহজালাল (র.) ২৩ টি বছর আরাধনায় কাটিয়েছেন। মাজারের পূর্ব দিকে একতলা একটি ঘরের ভেতরে এরপর দেখতে পারেন বড় তিনটি ডেকচি । কথিত আছে এই ডেকচির প্রত্যেকটিতে সাতটি গরুর মাংস ও সাত মণ চাল এক সাথে রান্না করা যায়। যদিও এগুলোতে রান্না হয় না। হযরত শাহজালাল(রাঃ) এর মাজারের পাশে রয়েছে নায়ক সালমান শাহ’র কবর। এটি ও সিলেটের দর্শনীয় স্থান সমূহের মধ্যে অন্যতম।