দর্শনীয় স্থানবাংলাদেশ ভ্রমণ গাইডসিলেট বিভাগসুনামগঞ্জ

টাঙ্গুয়ার হাওর কিভাবে যাবেন,কোথায় থাকবেন, ভ্রমণকালীন খাওয়া দাওয়া সহ বিস্তারিত ট্যুরিস্ট গাইড!

বাংলাদেশকে হাওড়-বাওড়ের দেশ বলার সবচেয়ে বড় কারণ হলো এই দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য হাওরের অস্তিত্ব! এসব হাওরের বেশকিছু হাওর দেখতে এতোটাই অপরূপা যে দেশের প্রথম সারির পর্যটন এলাকা হিসেবে এসমস্ত হাওরকে স্বীকৃতি দিলেও অত্যুক্তি করা হবে না। তেমনই একটি হাওর নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো। যে হাওর ভ্রমণে স্বর্গীয় সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বলছিলাম টাঙ্গুয়ার হাওরের কথা। চলুন তবে বিস্তারিত জানা যাক! সাথে জানা যাক টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের গাইডলাইন সম্পর্কে! 

টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ – Tanguar Haor Sunamganj

টাঙ্গুয়ার হাওর পরিচিতি

পরিচিতির দিক দিয়ে এই হাওরের অপর নাম হলো হাওর কন্যা। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে পুরোপুরি পারফেক্ট এই টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের অন্যতম সুন্দর ও জীব-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি হাওর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এতে থাকা পানি কিন্তু মিঠা পানি। অর্থ্যাৎ এই টাঙ্গুয়ার হাওর মূলত একটি মিঠা-পানির হাওর। 

বাংলাদেশে যে ক’টি হাওর আয়তনের দিক দিয়ে বেশ বড় সে ক’টি হাওরের মাঝে অন্যতম হলো এই টাঙ্গুয়ার হাওর। বলে রাখা ভালো প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সৌন্দর্যের আঁধার এই টাঙ্গুয়ার হাওর। আয়তন, সৌন্দর্য এবং পানির প্রকারভেদের উপর ভিত্তি করে সম্প্রতি টাঙ্গুয়ার হাওরকে বাংলাদেশর দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। 

সারা বাংলাদেশের ভ্রমণপিয়াসীরা এই হাওরকে টাঙ্গুয়ার হাওর হিসেবে চিনে থাকলেও স্থানীয়রা এই হাওরকে নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল হিসেবে চিনে। অনেকেই আবার এই অনন্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভরপুর স্থানটিকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থানও বলে থাকে। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো বাংলাদেশের প্রথম রামসার স্থান হিসেবে সুন্দরবনকেই ধরে নেওয়া হয়।

আজকের এই Tanguar Haor তৈরি হয়ে উঠার পেছনে কাজ করেছে নিয়মিত ঝর্ণা থেকে ঝড়ে পড়া পানি। প্রসঙ্গত মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০ টির চাইতেও বেশি ঝর্ণা থেকে ঝড়ে পড়া পানি এসে মিশেছে এই টাঙ্গুয়ার হাওরে। যার ফলে এটি তৈরি হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির জলাভূমি হিসেবে৷ 

প্রায় ৯,৭২৭ হেক্টরের মতো এলাকা নিয়ে গড়ে উঠা এই টাঙ্গুয়ার হাওরের রয়েছে ২ টি উপজেলা। আবার সেই ২ টি উপজেলার রয়েছে ১৮ টির মতো মৌজা এবং ১৮ টি মৌজার রয়েছে সবমিলিয়ে ৫১ টি হাওর। 

এক্ষেত্রে ২৮ বর্গকিলোমিটার স্থান জুড়ে কেবল মিঠাপানি রয়েছে। বাকি স্থানটুকুতে ঠাঁই পেয়েছে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি, প্রয়োজনীয় উঠান এবং বিভিন্ন কৃষিজমি। ১৯৯৯ সালের দিকে এই হাওরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলেও পরবর্তীতে অর্থ্যাৎ ২০০০ সালের দিকে আবারো তা সাধারণ পর্যটকদের উদ্দেশ্যে খুলে দেওয়া হয়। 

সারা বছরই এই টাঙ্গুয়ার হাওরে পানি থাকে। তবে শীতকালের দিকে এই পানির পরিমাণ কিছুটা কমে আসে। সেই পানি কমে আসা খালি জায়গায় কৃষকেরা নতুন করে বিভিন্ন সিজনাল ফসল চাষ করে। মিঠা পানির কারণে এসমস্ত স্থানে বেশ ভালো ফলন হয়। যা দেশের কৃষি খাতে বাড়তি অবদান রাখছে। 

টাঙ্গুয়ার হাওর কোথায় অবস্থিত – Tanguar Haor Location

অবস্থানগত দিক দিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর সিলেট বিভাগের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান। বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত এই হাওর সারা বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাধার! ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত সময়ে এই হাওর ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে পরিচিত থাকলেও পরবর্তীতে দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারির পালা শেষ হয় এবং এই স্থান বা হাওরটিকে  ‘রামসার স্থান’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।

Tanguar Haor Map 

টাঙ্গুয়ার হাওর এর সৌন্দর্য 

Tanguar Haor এর সৌন্দর্যের বর্ণনা হয়তো দিয়ে কখনো শেষ করা যাবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত এই হাওর নিজ চোখ দ্বারা উপভোগ না করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত কেবল এর বর্ণনা শুনে এর সৌন্দর্য আন্দাজ করা সম্ভব নয়। 

শুরুতেই বলে রাখি এই টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জের ছোট-বড় প্রায় ১২০ টি বিলের সমন্বয়ে গঠিত একটি জলাধার। ১০০ টিরও বেশি বিল দ্বারা এই হাওর তৈরি হওয়ায় বর্ষাকালে বিল, সাধারণ ভূমি সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে পড়ে। 

যারা Tanguar Haor উপভোগ করতে যান তাদের মাথায় এই স্থানটিতে বারবার ঘুরতে যাওয়ার ঝোঁক থাকে। কেননা ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করতে সক্ষম এই টাঙ্গুয়ার হাওর। এছাড়াও গাছ, মাছ, পাখি আর প্রাকৃতিক জীব-বৈচিত্র্যের এক অনন্য সংমিশ্রণ উপভোগ করার মতো সুযোগ তো থাকছেই! 

শীতকালে এই Tanguar Haor হয়ে উঠে উপভোগ করার মতো শ্রেষ্ঠ কোনো এক দর্শনীয় স্থান। বিশেষ করে এতে উড়ে আসা অতিথি পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ উপভোগ করার লোভ সামলাতে পারে না অনেক দর্শনার্থীরাই। 

তবে বর্ষাকালকে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের শ্রেষ্ট সময় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এর মূল কারণ হলো এই সময়টাতে সৌন্দর্যে রূপে-গুণে অনন্য হয়ে উঠে টাঙ্গুয়ার হাওর নামের এই মিঠাপানির হাওরটি। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির ঠিক মাথার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল খোলা আকাশ যেকোনো দর্শনার্থীর মনে অন্যরকম এক প্রশান্তির সৃষ্টি করে। 

যদিও শীতকালটাও এই Tanguar Haor ভ্রমণের ক্ষেত্রে মোটেও খারাপ কোনো সময় নয়। শীতকালের দিকে এই স্থানটিতে ভ্রমণ করতে গেলে পায়ে হেঁটেই হিজল ও করচ বাগানের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মতো দারুণ সুযোগকে কাজে লাগানো যায়। কেননা এই সময়টাতে টাঙ্গুয়ার হাওরে পানির পরিমাণ একেবারেই কমে যায়। 

বর্তমানে সারা Tanguar Haor ঘুরে-বেড়ানোর উদ্দেশ্যে আধুনিক ও আরামদায়ক নৌকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে একজন দর্শনার্থী হিসেবে স্থানটিকে আরো বেশি উপভোগ্য মনে হবে আপনার। 

টাঙ্গুয়ার হাওরে যেভাবে যাবেন

মূলত টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবার আগে আপনাকে পৌঁছাতে হবে সুনামগঞ্জ জেলায়। ঢাকা কিংবা অন্য যেকোনো জেলা থেকে সড়ক পথ ব্যবহার করে পৌঁছে যাওয়া যাবে এই সুনামগঞ্জ জেলায়। সুনামগঞ্জ জেলায় পৌঁছে লেগুনা কিংবা অটো রিকশায় করে সরাসরি চলে যেতে হবে তাহেরপুর। সবশেষে তাহেরপুর থেকে সরাসরি টাঙ্গুয়ার হাওর! 

টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে যেখানে খাওয়া-দাওয়া করবেন

খাওয়া-দাওয়ার সাথে ভ্রমণের রয়েছে নিবিড় এক সম্পর্ক। এই সম্পর্কে টানা-হেঁচড়ায় পড়লে ভ্রমণটা কেমন জানি পানসে মনে হয়। Tanguar Haor ভ্রমণকেও পানসে না করতে চাইলে জেনে নিন টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণকালীন সময়ে কিভাবে বা কোত্থেকে খাবার-দাবার সংগ্রহ করবেন সে-সম্পর্কে। 

Tanguar Haor ভ্রমণের সময় চাইলে তাহিরপুরের যেকোনো হোটেল থেকে নিজের এবং ভ্রমণসঙ্গীদের জন্য খাবার সংগ্রহ করে নিতে পারেন। এছাড়াও টাঙ্গুয়ার হাওর এর ফ্রেশ মাছ রান্না কিংবা ভাজাভাজির কাজ সেরে তা দিয়ে ইজিলি পেটের মরা ইদুঁরকেও বাঁচিয়ে তুলতে পারেন৷ 

আর যারা পিকনিকের মতো করে ক’টা দিন থেকে নিজেরাই রান্নাবান্না করে খেতে চান তারা তাহিরপুর বাজার থেকে কাঁচাবাজার সেরে টাঙ্গুয়ার হাওরের ফ্রেশ মাছ সংগ্রহ করে তা নিজেরাই রান্না করে নিতে পারেন। 

টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে যেখানে রাত্রিযাপন করবেন

টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের ক্ষেত্রে চাইলে আপনি সেখানকার নৌকাতেই রাত কাটাতে পারেন। এছাড়াও টেকেরঘাট এলাকায় হাওর বিলাসে নিজের থাকার ব্যবস্থা করে নিতে পারেন। টাঙ্গুয়ার হাওরে রাত কাটানোর মতো অন্য কোনো মাধ্যম কিংবা উপায় নেই। তবে সবচেয়ে বেশি ভালো হয় নৌকায় রাত কাটাতে পারলে! এতে করে নতুন এক্সপেরিয়েন্স হওয়ার পাশাপাশি ভ্রমণটাও বেশ উপভোগ্য মনে হবে। 

ইতি কথা

ইতিমধ্যেই হয়তো বুঝতে পেরেছেন ভ্রমণের মাধ্যমে মনকে শান্ত করার মতো পর্যটন এলাকা হিসেবে Tanguar Haor ঠিক কতটা পারফেক্ট! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই হাওরে ঘুরাঘুরি করার সময় কিছুটা সমুদ্র সমুদ্র ফিল আসে। যা আপনার মিস করে আসা সমুদ্র ভ্রমণ এবং এর আফসোসের প্রতিও কিছুটা সমবেদনা জানাতে পারবে। যাইহোক!

টাঙ্গুয়ার হাওর সম্পর্কিত আমাদের আজকের এই আয়োজন কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু! আশা করি আমাদের এই পরিপূর্ণ গাইডলাইন আপনার পরবর্তী ভ্রমণকে সহজ করে তুলবে। ধন্যবাদ সবাইকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *