খাগড়াছড়ি জেলার দর্শনীয় স্থান (Khagrachari Tourist Spot) সমূহের তালিকা সহ বিস্তারিত তথ্য জানুন!
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’- জীবনানন্দ দাশের এই বিখ্যাত চরণটির যথার্থতা দেখতে পাবেন অপরুপ পর্যটন ভূমি খাগড়াছড়ি গেলে। সত্যি বলতে আমাদের তো মন চায় প্রজাপতি হয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেরাতে, কিংবা পাখির মত ডানা ঝাপটিয়ে ইচ্ছেমত সবদিকে উড়ে বেড়াতে, কিন্তু আমাদের দ্বারা তো তা আর সম্ভব না।
কিন্তু আপনি চাইলেই যে কোন সময় ছুটে যেতে পারেন পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে। খাগড়াছড়ির পাগল করা সৌন্দর্যের টানে সেখানে পর্যটকরা বারবার ছুটে যায়। খাগড়াছড়িতে রয়েছে অসংখ্য নদী, পাহাড়, লেক আর আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তার দুপাশে সবুজের সমারোহ, স্নিগ্ধ বাতাস, মেঘের লুকোচুরি আর মেঘ ছোঁয়ার অনুভূতি পাওয়ার জন্য হলেও আপনাকে জীবনে একবার হলেও খাগড়াছড়ি আসতেই হবে। চলুন তাইলে এক পলকে দেখে নিই খাগড়াছড়ির দর্শনীয় স্থান সমূহের মধ্যে কোন কোন জায়গায় না গেলেই নয়।
খাগড়াছড়ির দর্শনীয় স্থান – Khagrachari Tourist Spot
আলুটিলা গুহা – Alutila Cave
খাগড়াছড়ির দর্শনীয় স্থান সমূহের মধ্যে আলুটিলা গুহা অন্যতম। খাগড়াছড়ি জেলায় অবস্থিত মাটিরাঙ্গা মূল শহর হতে ৭ কি.মি পশ্চিমে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে সমুদ্র সমতল হতে ৩০০০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট আলুটিলা পাহাড়ের চূড়া থেকে ২৬৬টি সিঁড়ি পেরিয়ে পাহাড়ের শিলা মাটির ভাঁজে গড়া এ রহস্যময় আলুটিলা নামক গুহা সুড়ঙ্গের অবস্থান। দেবতার গুহা নামেই স্থানীয়দের কাছে পরিচিত এই গুহাটি। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫০ ফুট এবং একপাশ হতে অন্যপাশ যাওয়ার আনুমানিক দূরত্ব ১০-১৫ মিনিট। গুহাটির উচ্চতা মাঝে মাঝে খুব কমে যাওয়ায় একপর্যায়ে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয়। এতো দুর্গমতার পরেও পর্যটন কেন্দ্রের প্রধান আকর্ষণ এই রোমাঞ্চকর সুড়ঙ্গ। তলদেশে ঝর্ণা প্রবাহিত সুড়ঙ্গের মেঝে পিচ্ছিল এবং পাথুরে হওয়ায় গুহাটি দেখতে অনেকটা ভূ-গর্ভস্থ টানেলের মত।
আলুটিলার গুহায় যেতে হলে প্রথমেই আপনাকে টিকেট কেটে নিতে হবে মূল গেট থেকে। ফটকের দুই পাশে দুটি শতবর্ষী বটবৃক্ষ আপনাকে স্বাগত জানাবে। এই গুহাতে সূর্যের আলো খুব কম হওয়ায় ফটক দিয়ে পর্যটন কেন্দ্রে প্রবেশের সময়ই আপনাকে মশাল সংগ্রহ করতে হবে। প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করে ডান পাশের রাস্তা দিয়ে কয়েক মিনিট হেঁটে একটি সরু পাহাড়ীপথ বেয়ে নিচে নামলেই আপনার চোখে ধরা দিবে একটি ছোট ঝর্ণা। এই ঝর্নাটির ঝিরি ধরে খানিকটা পথ পেরুলেই মিলবে আলুটিলা গুহার সন্ধান। গুহার পাথর গুলো পিচ্ছিল হবার কারনে পা পিছলে যায় এমন স্যান্ডেল বা জুতা এই গুহায় যাও্রয়ার সময় নিবেন না। অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য চাইলে টর্চ লাইট নিয়ে যেতে পারেন আপনার সঙ্গে।
হৃদয় ছুয়ে যাওয়া অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অধিকারী এ গুহা আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় প্রায় সারা বছরই এখানে প্রচন্ড ভিড় লেগে থাকে। ভ্রমন ও রোমাঞ্চপ্রেমীদের জীবনে অন্তত একবার হলেও ঘুরে আসা উচিত এই গুহাটি। “আলুটিলা” নামে টিলা হলেও মূলত এটি খাগড়াছড়ি জেলার সবচেয়ে উঁচু পর্বত। এখান থেকে খাগড়াছড়ী শহরের বেশ কিছুটা অংশ দেখা যায়। আলুটিলা গুহা থেকে আরো দেখা মিলবে আকাশ পাহাড় আর মেঘের মিতালীতে গড়া মায়াবী এক দৃশ্যের।
নিউজিল্যান্ড পাড়া – New Zealand Para Khagrachari
“বাংলাদেশ” নামেও গ্রাম আছে ভারতের কাশ্মীর সহ বেশ কিছু দেশে এই কথাটা আমরা বিভিন্ন সময় শুনেছি। তবে নিউজিল্যান্ড পাড়া!!! হ্যা ঠিকি পড়েছেন ।শুনতে খুব অদ্ভুত মনে হলেও সত্যি সত্যি বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি থেকে ১.৫ কিলোমিটার দক্ষিণে পানখাইয়া পাড়ার পাশে অবস্থিত এই নিউজিল্যান্ড পাড়া। এই নামকরনের পিছনে তেমন কোন কারন নেই। খাগড়াছড়িতে একমাত্র সমতল ভূমি বলতে আছেই এই নিউজিল্যান্ড পাড়া। বিস্তৃত সবুজ শস্যখেত আর দূরের পাহাড়ের সারির মিতালি এখানে এক নান্দনিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে।
আর এই কারণেই জায়গাটি আলাদাভাবে পর্যটকদের নজর কেড়েছে। স্থানীয় ভাবে প্রচলিত আছে, অনেক অনেক বছর আগে এক ভদ্রলোক এই এলাকা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, এই এলাকার বাতাস নিউজিল্যান্ডের মতোই; সেই থেকেই এই এলাকার নাম নিউজিল্যান্ড পাড়া! অপরুপ সুন্দর প্রকৃতির এক অনবদ্য রূপফল এই এলাকা। এখানে গেলে দৃষ্টি সীমানায় শুধু চোখে পড়বে সবুজ আর সবুজ। দূরে অল্প কিছু বাড়িঘর আর দৃষ্টিসীমান্তের অগোছড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি উঁচু পাহাড়। এমন অপরুপ দৃশ্যের দেখা মিলবে নিউজিল্যান্ড পাড়ায়। গাড় সবুজ পাহাড় সুনীল আকাশ আর তারই মাঝে শুভ্র মেঘ সবকিছু এখানে মিলেমিশে একাকার। চারপাশের এই সবুজ স্নিগ্ধ রূপ আপনাকে বিমোহিত করবেই।
স্নিগ্ধ খাগড়াছড়ির পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে যাওয়া পানির স্রোত মিলেমিশে একাকার হয়েছে কর্ণফুলী নদীর সাথে। এই বহমান পানির মাঝে কোথাও সবুজের চাদরে মোড়ানো জুম চাষের ক্ষেত,কোথাও বা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মাঝে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনধারা এই খাগড়াছড়িতে এনে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়িগামী বাসে চড়ে ঢাকা বাঁ চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি শহরে আসতে হবে। এরপর শহর থেকে সিএনজি বা অটোতে করে নিউজিল্যান্ড পাড়া যেতে পারবেন, এতে ১০-২০ টাকার মত ভাড়া পড়বে । নিউজিল্যান্ড পাড়া খাগড়াছড়ির দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে অন্যতম।
তৈদুছড়া ঝর্ণা
দীঘিনালা উপজেলায় সবুজ পাহাড় আর বুনো জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত নয়নাভিরাম এক ঝর্ণা হল তৈদুছড়া ঝর্ণা। ত্রিপুরা ভাষায় এর অর্থ দাড়ায় পানির দরজা। এই ঝর্ণার উচ্চতা প্রায় ৩০০ ফুট। পাহাড়ের গায়ে থাকা পাথরের ধাপ আর জল গড়িয়ে নিচে পড়ার দৃশ্য তৈদুছড়া ঝর্ণাকে অনন্য করেছে অন্য সব ঝর্ণা থেকে। খাগড়াছড়ির দর্শনীয় স্থান সমূহের মধ্যে এই ঝর্নায় না গেলেই নয়। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আঁকা বাঁকা পাহাড়ের ভাঁজ ঘেঁষে বয়ে চলে তৈদুছড়া ঝর্ণার পানি। একদম শীতল আর স্বচ্ছ পানির কলকল করে ছুটে চলার শব্দে সবসময় মুখর থাকে চারপাশর পরিবেশ। প্রায় ৩০০ ফুট উচু থেকে গড়িয়ে পড়া পানি এসে পরে নিচের পাথুরে ভূমিতে।
এই ঝর্ণার ডানপাশ দিয়ে পাহাড়ের উপরে থাংঝাং ঝর্ণা নামে আরেকটি ঝর্ণা রয়েছে। মূলত থাংঝাং ঝর্ণা থেকে প্রবাহিত পানি থেকেই এই ঝর্ণার সৃষ্টি হয়েছে। তৈদুছড়া ঝর্ণায় খাগড়াছড়ি থেকে দুই ভাবে যাওয়া যায়। একটি হল সীমানা পাড়া হয়ে এবং অন্যটি হল দিঘীনালা দিয়ে। যদি সীমানা পাড়া হয়ে যেতে চান তাহলে খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা মোড় থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে নয় মাইল নামক স্থানে নেমে দীঘিনালা গামী যে কোন বাসে নয় মাইল যেতে হবে। সেখান থেকে ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে সীমানা পাড়া যেতে হবে। সীমানা পাড়া থেকে আপনাকে গাইড ঠিক করে তৈদুছড়ার পথে হাঁটতে হবে। প্রায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের পখ হাঁটলে সামনে পড়বে অপরুপ।
আর দীঘিনালা হয়ে যদি যেতে চান তাহলে বাসে করে খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা মোড় থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে দীঘিনালা বাস স্টেশনে যেতে হবে। সেখান থেকে দীঘিনালা বাজার গিয়ে গাইড ঠিক করতে হবে। তারপর জামতলি নামক জায়গা থেকে আপনাকে ট্র্যাকিং শুরু করতে হবে। উঁচু নিচু পাহাড় আর ঝিরিপথ পার করে প্রায় ৩ ঘণ্টা হাটার পর দেখা পাবেন তৈদুছড়া ঝর্ণার । মনে রাখবেন সীমানা পাড়া দিয়ে গেলে কম সময়েই এই ঝর্ণায় যেতে পারবেন
হর্টিকালচার পার্ক – Horticulture Park Khagrachari
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার অন্যতম আকর্ষণ হল “হর্টিকালচার পার্ক”। খাগড়াছড়ির পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘুমিয়ে থাকে শান্ত জলের হ্রদ আর পথে পথে নদী বয়ে চলে তার আপন মনে। এই খাগড়াছড়ির প্রতিটি পরতে পরতে যেন লুকিয়ে আছে অদেখা অতি প্রাকৃত এক ভূবন। তেমন ই এক ভূবন হল হর্টিকালচার পার্ক
হর্টিকালচারে পার্কে যা যা দেখতে পাবেন
- একটি অপরুপ ঝুলন্ত ব্রীজ।
- সবুজ বেস্টনী দিয়ে ঘেরা অপরুপ কৃত্রিম হ্রদ।
- গেস্টহাউজ এবং হলরুম
- পিকনিক করার জন্য অপরুপ স্পট।
- স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবারের পসরা
- বার্ডস পার্ক এবং অবজারভেশন টাওয়ার ।
খাগড়াছড়ি সদর বাজার হতে গঞ্জপাড়া রোড দিয়ে অটোরিকশায় ১০টাকা কিংবা রিকশায় জনপ্রতি ২৫টাকা খরচে অথবা মোটরসাইকেল সহ সকল যানবাহনে খুব সহজে যেতে পারবেন এই হর্টিকালচার পার্কে।